স্টক নিউজ বিডি প্রতিবেদন: বর্তমানে দেশের শেয়ারবাজার কতটা ঝুঁকিপূর্ণ । গত এক মাসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বাজারমূলধন ৮৫ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। এ সময় মূল্যসূচক বেড়েছে প্রায় ১ হাজার পয়েন্ট। ইতোমধ্যে বেশকিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম এমনভাবে বেড়েছে, যা কোনোভাবেই সেগুলোর মৌলভিত্তির সঙ্গে যায় না। প্রথমত, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির বর্তমান পরিস্থিতির প্রভাব এবং দ্বিতীয়ত, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বিভিন্ন উদ্যোগে বাজারে টাকার প্রবাহ বেড়েছে। কিন্তু বিনিয়োগযোগ্য কোম্পানির সংখ্যা কম। এ কারণে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দামও লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। যা বাজারের জন্য অত্যন্ত খারাপ দিক।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, সামগ্রিকভাবে বাজারের মূল্যস্তর এখনো ঝুঁকিতে যায়নি। এখনো কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম বৃদ্ধির সুযোগ রয়েছে। তবে সমস্যা অন্য জায়গায়। খুব দ্রুততম সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। এটি ইতিবাচক নয়। এছাড়া নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষ থেকে দাম বাড়তে সহায়তা করা হচ্ছে। যেমন- আইপিও (প্রাথমিক শেয়ার) আবেদনের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর অ্যাকাউন্টে ২০ হাজার টাকা রাখার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এর মানে হলো, একটি গ্রুপের মাধ্যমে শেয়ারের দাম বাড়িয়ে অন্য গ্রুপকে অর্থ উপার্জনে সহায়তা করা হচ্ছে। তৃতীয়ত বিষয় হলো, সাম্প্রতিক সময়ে বিএসইসি একটি সার্কুলার দিয়ে, পরের দিন তা প্রত্যাহার করেছে। এতে নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়।
জানা গেছে, গত এক মাসে ডিএসইর বাজার মূলধন ৪ লাখ ১৬ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৫ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। গত এক সপ্তাহে ডিএসইর গড় লেনদেন ছিল প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা। বেশ কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। কোম্পানির উদ্যোক্তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী। এসব কোম্পানির শেয়ারের মূল্য কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানগুলোর মৌলভিত্তির সঙ্গে যায় না। বেশ কয়েকটি হাউজ এবং উদ্যোক্তারা এর সঙ্গে জড়িত। প্রথমে উদ্যোক্তাদের পক্ষ বিভ্রান্তিকর মূল্য সংবেদনশীল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে হাউজগুলো থেকে অস্বাভাবিকভাবে শেয়ার কিনে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে শেয়ারের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুনির্দিষ্ট কয়েকটি কারণে বাজারের এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। প্রথমত, করোনার কারণে বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারের দাম কমার ক্ষেত্রে ফ্লোর প্রাইস দেওয়া আছে। এর মানে হলো, শেয়ারের দাম যেই হারে বাড়তে পারবে, কমার হার তার চেয়ে কম। দ্বিতীয়ত, করোনার পরে মানুষের বিনিয়োগের সুযোগ কমেছে। এর মধ্যে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণ প্রবাহ কমেছে। গত জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষিত মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ। এ পর্যন্ত এ খাতে প্রবৃদ্ধি মাত্র ৮ দশমিক ৭ শতাংশ। ফলে ব্যাংকগুলোর হাতে পর্যাপ্ত অর্থ রয়েছে।
সর্বশেষ হিসাবে ব্যাংকে অলস অর্থ ১ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। যার উল্লেখযোগ্য অংশ শেয়ারবাজারে আসছে। এছাড়াও আমানতের সুদের হার অস্বাভাবিকভাবেই কমেছে। ব্যাংকে টাকা রাখলে গ্রাহককে ৬ শতাংশ সুদ দেওয়া হয় না। কোনো কোনো ব্যাংকে এই হার ৫ শতাংশেরও কম। ফলে আমানতকারীদের একটি অংশ শেয়ারবাজারে আসছে। এছাড়া চলতি বছরের বাজেটে শেয়ারবাজারে বিনা প্রশ্নে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। আর এই কালো টাকাও বাজারে আসছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুসারে গত ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত ১৩৮ জন বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে কালো টাকা বিনিয়োগ করেছেন। বর্তমানেও সেই ধারা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে বাজারে টাকার প্রবাহ ও বিনিয়োগ বাড়াতে বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে বিএসইসি। এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ১৫ হাজার কোটি টাকার তহবিলের আবেদন করেছে। এছাড়া এর আগে বাজারে ব্যাংকগুলোর শেয়ারবাজারে নতুন করে দু’শ কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বেশ কয়েকটি ব্যাংকের এই পরিমাণ বিনিয়োগ নেই। অন্যদিকে কয়েকটি ব্যাংক বন্ডের অনুমোদন পেতে বিএসইসিতে আবেদন করেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১০ সালের সঙ্গে তুলনা করলে ক্রমেই ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে বাজার। ওই সময়েও বিভিন্ন খাত থেকে বাজারে অস্বাভাবিকভাবে তারল্য প্রবাহ বেড়েছিল। কিন্তু ভালো কোম্পানির সংখ্যা ছিল হাতেগোনা কয়েকটি।
এ কারণে দুর্বল কোম্পানির শেয়ারের দামও বেড়েছিল। বর্তমানে ওই অবস্থার খুব বেশি উন্নতি হয়নি। শেয়ারবাজারে বিনিয়োগযোগ্য ভালো কোম্পানির সংখ্যা কম। এ কারণে এখনো দুর্বল কোম্পানিতে বেশি বিনিয়োগ হচ্ছে। বাজারে ২১টি খাতের মধ্যে ওষুধ খাত ছাড়া কোনো কোম্পানির ভালো ব্যবসা নেই। কিন্তু এই বাস্তবতা উপেক্ষা করে দ্রুততম সময়ে কিছু কোম্পানির শেয়ারের দাম বেড়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই খাতভিত্তিক। গত ৪ মাস বাজারে বীমা খাতের আধিপত্য ছিল। এরপর আইটি, মিউচুয়াল ফান্ডসহ একেক সময়ে একেক খাত সামনে আসছে।
সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে ওষুধ খাতের দু-একটি কোম্পানি এবং টেলিকম খাতের রবির শেয়ারের দাম বাড়ছে। অর্থাৎ নির্দিষ্ট কিছু খাত ও কোম্পানি বাজারে আধিপত্য চলছে। এর প্রভাবে দুর্বল কোম্পানির দাম বাড়ছে। এছাড়া প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারে এখনো ওইভাবে সক্রিয় হয়নি। অন্যদিকে বিএসইসির পক্ষ থেকেও শক্ত অবস্থানে ঘাটতি রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সম্প্রতি শেয়ারবাজারে কারসাজির তদন্ত সংক্রান্ত চিঠি এক রাতেই প্রত্যাহার করেছে বিএসইসি। বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, আমরা সার্ভিল্যান্সের মাধ্যমে সেকেন্ডারি মার্কেটকে মনিটরিং করছি। সেক্ষেত্রে বাজারে অস্বাভাবিক কোনো কিছু পেলে আমরা চিহ্নিত করছি। এক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ইনভেস্টিগেশন চলছে। কোনো ব্যক্তি বা সংঘবদ্ধের গ্রুপের বেআইনি কার্যক্রম চিহ্নিত হলে, আইন অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্টক নিউজ বিডি.কম/ এসআর
আরও পড়ুন……